নাজমুল হোসেন শান্ত: বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়কের গল্প

বাংলাদেশ ক্রিকেটের আকাশে যখন নতুন তারার সন্ধান চলছিল, ঠিক তখনই ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে নাজমুল হোসেন শান্ত-এর। শুধুমাত্র একজন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান হিসেবে নয়, বরং একজন বিচক্ষণ নেতা হিসেবেও তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অল্প সময়ের মধ্যেই। রাজশাহী বিভাগের রণহাট থেকে উঠে এসে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব পাওয়া – এই যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিল না।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে শুরুটা মসৃণ ছিল না। ধারাবাহিকতার অভাব এবং প্রত্যাশার চাপ তাকে বেশ ভুগিয়েছে। অনেক ম্যাচেই ভালো শুরু করেও বড় ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। সমালোচকদের তীর্যক মন্তব্যও সহ্য করতে হয়েছে তাকে। একটা সময় দল থেকে বাদ পড়াটাও সহজ ছিল না। কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর ক্রিকেটীয় মেধার সমন্বয়ে তাকে এসব পরীক্ষা পাড়ি দিতে হয়।

কিন্তু শান্ত দমে যাওয়ার পাত্র নন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরে গিয়ে নিজের ব্যাটিং নিয়ে আরও কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) তার পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো। নিজের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে আরও পরিণত ব্যাটসম্যান হিসেবে ফিরে আসার সংকল্প ছিল তার। আজ তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম ভরসার নাম।

প্রারম্ভিক জীবন ও ক্রিকেটে হাতেখড়ি

নাজমুল হোসেন শান্ত-এর জন্ম ১৯৯৮ সালের ২৫শে আগস্ট, রাজশাহীর এক শান্ত গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা। স্থানীয় মাঠগুলোতে টেপ টেনিস বলে খেলা শুরু করলেও তার প্রতিভা নজর কাড়ে স্থানীয় কোচদের। প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় রাজশাহীর ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে। সেখান থেকেই ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া। ঘরোয়া ক্রিকেটে বয়সভিত্তিক দলগুলোতে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাকে দ্রুতই নির্বাচকদের নজরে নিয়ে আসে।

অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে তার পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৬ সালের আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ দলের অন্যতম সেরা পারফরমার। টুর্নামেন্টে তিনি একটি সেঞ্চুরিসহ মোট ২৫৯ রান করেন, যা তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি এনে দেয়। ঘরোয়া ক্রিকেটেও তার ব্যাট কথা বলেছে নিয়মিত। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (BCL) এবং ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (DPL) ধারাবাহিক রান করে জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়তে থাকেন তিনি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ও পথচলা

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে নাজমুল হোসেন শান্ত-এর টেস্ট অভিষেক হয়। যদিও শুরুর দিকের পথচলা খুব একটা মসৃণ ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপ এবং প্রত্যাশার ভারে অনেক সময়ই তাকে ভুগতে হয়েছে। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। নিজের দুর্বলতাগুলো নিয়ে কাজ করেছেন, টেকনিক উন্নত করেছেন এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন।

ধৈর্য এবং কঠোর পরিশ্রমের ফল তিনি পেতে শুরু করেন ধীরে ধীরে। বিশেষ করে টেস্ট ফরম্যাটে তার উন্নতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্যালেকেলে টেস্টে ১৬৩ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলেন তিনি, যা তার ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। এই ইনিংসটি তার সামর্থ্যের জানান দেয় এবং দলে তার জায়গা পাকাপোক্ত করতে সাহায্য করে। এরপর থেকে তিনি তিন ফরম্যাটেই দলের নিয়মিত সদস্য হয়ে ওঠেন।

  • টেস্ট অভিষেক: ২০ জানুয়ারি, ২০১৭, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড (ক্রাইস্টচার্চ)
  • ওডিআই অভিষেক: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান (আবু ধাবি)
  • টি-টোয়েন্টি অভিষেক: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে (চট্টগ্রাম)

নেতৃত্বের মঞ্চে শান্ত

সাকিব আল হাসান এবং লিটন দাসের অনুপস্থিতিতে বা অবর্তমানে নাজমুল হোসেন শান্ত-কে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং সিরিজ ড্র করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।

তার শান্ত কিন্তু দৃঢ় নেতৃত্বগুণ প্রশংসিত হয়েছে। মাঠে ফিল্ড প্লেসমেন্ট, বোলার পরিবর্তন এবং কঠিন মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার পরিপক্কতা চোখে পড়ার মতো। ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর তাকে তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, যা তার ক্যারিয়ারের এক নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা একবার বলেছিলেন, “শান্ত’র মধ্যে দারুণ সম্ভাবনা আছে। তাকে সঠিক পরিচর্যা এবং সময় দিলে সে বাংলাদেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।”

অধিনায়ক হিসেবে তার যাত্রাটা চ্যালেঞ্জিং হলেও তিনি শুরুটা করেছেন দারুণভাবে। তার নেতৃত্বে দল নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ঐতিহাসিক ওয়ানডে জয় পেয়েছে। তরুণ ক্রিকেটার এবং তাদের ওপর আস্থা রাখার প্রবণতা তার নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম একবার বলেছিলেন, “শান্ত’র মধ্যে আমি একজন ভবিষ্যৎ নেতার ছায়া দেখেছিলাম অনেক আগেই। তার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক খুবই পরিষ্কার।” এই কথাটিই যেন আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
নাজমুল হোসেন শান্ত: বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়কের গল্প

ব্যক্তিগত জীবন: নাজমুল হোসেন শান্ত বউ ও পরিবার

ক্রিকেট মাঠের বাইরে নাজমুল হোসেন শান্ত একজন পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ। ২০২০ সালে তিনি সাবরিন সুলতানা রত্নাকে বিয়ে করেন। নাজমুল হোসেন শান্ত-র বউ সাবরিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। কোভিডের কঠিন সময়ে ঘরোয়া আয়োজনেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।

দাম্পত্য জীবনের আনন্দময় অধ্যায়ে নতুন সংযোজন হয় ২০২২ সালে, যখন নাজমুল তার নিজের ২৫তম জন্মদিনে বাবা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এশিয়া কাপে যাওয়ার ঠিক আগে এই সুসংবাদ পান বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। বিশেষ সেই দিনে স্ত্রীর পাশে থাকতে তিনি জাতীয় দলের প্রস্তুতিপর্ব থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। সন্তান জন্মের খবরটি তিনি নিজেই ফেসবুকে পোস্ট করে জানান যে মা এবং শিশু উভয়েই সুস্থ আছেন।

শান্ত প্রায়শই সামাজিক মাধ্যমে পরিবারের সাথে ছবি শেয়ার করেন, যা ভক্তদের কাছে তার ব্যক্তিগত জীবনের একটি চিত্র তুলে ধরে।

নাজমুল হোসেন শান্ত-এর পরিসংখ্যান: এক ঝলক

একজন ক্রিকেটারের পারফরম্যান্স বিচারের অন্যতম মাপকাঠি হলো তার পরিসংখ্যান। নাজমুল হোসেন শান্ত-এর পরিসংখ্যান সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি কিছুটা নড়বড়ে ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি ধারাবাহিকতা খুঁজে পেয়েছেন।

  • টেস্ট: টেস্ট ফরম্যাটে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছেন। তার গড় এবং সেঞ্চুরির সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিশেষ করে লম্বা ইনিংস খেলার মানসিকতা তার টেস্ট ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করেছে।
  • ওডিআই: ওয়ানডে ক্রিকেটেও তিনি দলের অন্যতম ভরসা। টপ অর্ডারে নেমে ইনিংস গড়ার পাশাপাশি স্ট্রাইক রোটেট করার ক্ষমতা তাকে কার্যকর ব্যাটারে পরিণত করেছে।
  • টি-টোয়েন্টি: টি-টোয়েন্টিতেও শান্ত নিজের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছেন। পাওয়ার প্লে-তে দ্রুত রান তোলা কিংবা ইনিংস ধরে খেলার ক্ষমতা দুটোই তার মধ্যে বিদ্যমান। বিপিএলে তিনি বেশ কয়েকবার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় ছিলেন।

তার পরিসংখ্যান সময়ের সাথে সাথে আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে, যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ইতিবাচক দিক।

সমালোচনা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে শান্তকে পারফরম্যান্সের জন্য সমালোচিত হতে হয়েছে। বিশেষ করে শট সিলেকশন এবং ইনিংস বড় করতে না পারার প্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে তিনি এসকল সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত উন্নত করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (BCB) এবং নির্বাচকরা তার উপর আস্থা রেখেছেন।

অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক মনে করেন, শান্ত যদি তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেন এবং নেতৃত্বের চাপ সামলাতে পারেন, তবে তিনি হতে পারেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের দীর্ঘমেয়াদী কাণ্ডারি। তার ব্যাটিং কৌশল, ধৈর্য এবং শেখার আগ্রহ তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।

ক্রিকেট বিশ্বের উত্তেজনা এবং পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা সবসময় তুঙ্গে থাকে। বিশেষ করে যখন নাজমুল হোসেন শান্ত-এর মতো তারকারা মাঠে নামেন, তখন ভক্তদের আগ্রহ থাকে চরমে। এই উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন স্পোর্টস প্ল্যাটফর্ম। 

অনেক বাজি পর্যালোচনা প্ল্যাটফর্মই ক্রিকেট মৌসুম বা বড় টুর্নামেন্ট উপলক্ষে ব্যবহারকারীদের জন্য আকর্ষণীয় অফার নিয়ে আসে। এর মধ্যে সেরা সাইন আপ বোনাস একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, যা ব্যবহারকারীদের স্বাগত জানাতে এবং প্ল্যাটফর্মে তাদের যাত্রা শুরু করতে উৎসাহিত করে। শান্তর মতো খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনার সময় এই ধরনের প্ল্যাটফর্মগুলো ভক্তদের জন্য একটি বাড়তি রোমাঞ্চ যোগ করে।

উপসংহার

নাজমুল হোসেন শান্ত-এর গল্পটি অধ্যবসায়, পরিশ্রম এবং ঘুরে দাঁড়ানোর এক অনন্য উদাহরণ। একজন সাধারণ গ্রাম থেকে উঠে এসে জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়া এবং কোটি ভক্তের প্রত্যাশা পূরণ করা সহজ কাজ নয়। তার সামনে এখনও দীর্ঘ পথ বাকি। চ্যালেঞ্জ আসবে, সমালোচনা হবে, কিন্তু শান্ত’র প্রতিভা এবং মানসিক দৃঢ়তা তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেই ক্রিকেটপ্রেমীরা বিশ্বাস করেন।

নাজমুল হোসেন শান্ত শুধু একজন ক্রিকেটার নন, তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। তার ব্যাটে রানের ফোয়ারা আর নেতৃত্বে দলের সাফল্য – এটাই এখন সবার প্রত্যাশা।

মন্তব্য করুন

Top